আনোয়ার হোসেন আকাশ,
রাণীশংকৈল (ঠাকুরগাঁও) প্রতিনিধি:
স্বামীর দেওয়া আগুনে গুরুতর দগ্ধ
হয়ে যাওয়া দেহ নিয়ে গত ২৫ দিন ধরে ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন গৃহবধু ইসরাত জাহান সাথী (৩৩)। পাশে নেই কেউ।
মাদক সেবনে বাধা দেওয়ায় স্ত্রীর শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্বামীর বিরুদ্ধে। তার শরীরের প্রায় ৬০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
স্বামী রুবেল একজন মাদকসেবী ও ব্যবসায়ী বলে তার অভিযোগ।
জানা গেছে, ভুক্তভোগী ইসরাত জাহান সাথীর জন্ম সদর উপজেলার সালন্দর ইউনিয়নের চৌধুরীহাট বন্দিকার্ডা এলাকয়। জন্মের পর বাবা মারা যান। অভাবের সংসারে মা বেগম দুই বছর বয়সে সাথীকে শহরের হাজীপাড়া এলাকার ইমাম উদ্দিন-বিলকিস বানু দম্পতিকে দত্তক দেন। এরপর থেকে ইমাম উদ্দিন-বিলকিস বানুর মেয়ের পরিচয়েই বড় হচ্ছিলেন সাথী। ঠাকুরগাঁও মহিলা কলেজে এইচএসসি অধ্যায়নরত অবস্থায় ২০১২ সালে তাকে বিয়ে দেন তার পালিত মা-বাবা। ওই সংসারে তার ৪ বছরের একটি মেয়ে ও ৯ বছরের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। এরই মধ্যে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী রুবেল হোসেনের (৩৬) সঙ্গে। এরপর স্বামী-সন্তান রেখে পালিয়ে আসেন সাথী। পরে আবারও তার পরিবারের লোকজন তাকে বুঝিয়ে আগের স্বামীর কাছে পাঠালে ১৫ দিন সংসার করার পর পালিয়ে যায় তার জন্মদাতা মায়ের কাছে। এরপর রুবেল হোসেনের স্ত্রী-সন্তান থাকার সত্ত্বেও চার বছর প্রেম করে ২০২২ সালের শেষ দিকে পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করেন।
বিয়ের পর তারা ভাড়া বাসায় উঠেন পৌর শহরের নিশ্চিন্তপুর এলাকায়। তবে রুবেলের সঙ্গে তার মা-বাবার কোনো সম্পর্ক নেই। তারা অনেক আগেই ময়মনসিংহ থেকে এসেছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ে। শুরুতে সংসার ভালো চললেও বিয়ের কিছুদিন পর স্বামী মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। প্রতিদিন নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বাড়ি ফেরা, ঝগড়া-বিবাদ, মারধর সবই ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। চলতি মাসের শুরুর দিকে স্বামী মাদক সেবন করলে বাধা দেন সাথী। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। সাথীর চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা দৌড়ে এসে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন।
কিন্ত ২৫ দিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকলেও তার স্বামী ও পালিত মা-বাবা কেউ দেখতে আসেননি। এমনকি জন্মদাতা মা বেগম একদিন এসে সান্ত্বনা না দিয়ে উল্টো মারা যাওয়ার কথা বলে চলে যান। বর্তমানে সাথী মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকেরা ঢাকায় যাওয়ার পরামর্শ দিলেও অর্থের অভাবে যেতে পারছেন না।
হাসপাতালের বিছানায় বসে ইসরাত জাহান সাথী বলেন, আমার মা থেকেও নেই। দুই বছর বয়স থেকেই আমি অন্যের বাড়িতে মানুষ হয়েছি। আমি এতিম, বাবা নেই। যাদের মা-বাবা পরিচয় দিয়ে বড় হয়েছি তারাও আজ আমার এই করুণ দিনে পাশে নেই। প্রেম করে বিয়ে করেছি। ভালোবাসার টানে পরিবারকে উপেক্ষা করে নতুন সংসার গড়েছি। প্রথম কয়েক মাস ভালোই ছিল। কিন্তু তারপরই বাস্তবতা বদলে যায়। স্বামী নেশায় জড়িয়ে পড়েন-মাদক সেবন, অর্থের অভাব, ঝগড়া, গালাগালি-সবই ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। তবুও আমি চুপ ছিলাম। ভাবতাম মানুষটা একদিন বদলে যাবে। সে মানুষজন বাসায় এনে মাদকের ব্যবসা করে। নিজে মাদক খায়। অথচ আমি দিনের পর দিন না খেয়ে থাকি। সে আমাকে হাত-পা বেঁধে পেটায়। খাবার দেয় না। তারপরও সব যন্ত্রণা সহ্য করে সংসার করতে চেয়েছিলাম।
তিনি আরও বলেন, একদিন স্বামী মাদক সেবন করছিলেন, আমি তাতে বাধা দেই। এতে সে রাগে ক্ষোভে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমি ভালোবাসায় বিশ্বাস করতাম। এখন ভয় লাগে। আমার স্বামী আগুন দিয়েছে, কিন্তু তার চেয়ে বড় আগুন হচ্ছে এই অবহেলা। কেউ আমার খোঁজ নেয় না। না আমার শ্বশুরবাড়ির কেউ, না আমার নিজের পরিবার। আমি শুধু চাইছিলাম ওটা (স্বামী) মাদক খাওয়া ছাড়ুক। কিন্তু সেদিন আগুন দিয়ে হাসতে লাগলো। প্রতিবেশীরা না এলে হয়তো আজ আমি বাঁচতাম না।
ইসরাত জাহান সাথী বলেন, আমি বাঁচতে চাই। আমি আবার হাঁটতে চাই, কিন্তু ডাক্তার বলেছে উন্নত চিকিৎসা দরকার। সেই টাকা আমার কোথায়? আমার ঘুমাতে খুব ইচ্ছা করতেছে। এখান থেকে আমাকে ইঞ্জেকশন ওষুধ কিছুই দিচ্ছে না। জ্বালাপোড়া করছে স্যালাইন চাচ্ছি সেটাও দিচ্ছে না। ২৪ ঘণ্টায় আমার ৫-৬ মলমের প্রয়োজন, কিন্তু হাসপাতাল থেকে তো কিছুই দিচ্ছে না। শুধু সামান্য দুইটা ট্যাবলেট দেয়। আর ডাক্তার আসলে শুধু বলে বাড়ি চলে যাও। আমি যাব কোথায়? আমার জন্মদাতা মা থাকে চৌধুরীহাটে। আর পালিত মা থাকে হাজীপাড়ায়, ওরা ইচ্ছা করলেই লোক পাঠাতে পারে আমার কাছে। কিন্তু তারা এখন বলছে আমাদের কোনো মেয়ে নাই।
প্রশাসনের কাছে অনুরোধ আমাকে বাঁচান। আমি বাঁচতে চাই। আমাকে চেয়ে চেয়ে খেতে হয়। নিজ হাতে খেতে পারি না। কেউ খাওয়ায় দিলে খাই আর কেউ না দিলে না খেয়ে থাকি।
সাথীর পাশের বেডে থাকা অন্যান্য রোগীরা বলেন, মেয়েটা খুবই অসহায়। কেউ আসে না তাকে দেখতে। সে যে খাবার খাবে সেটাও খেতে পারে না। হাত অচল। আমরাই তার মুখে খাবার তুলে দেই। আমরা না থাকলে না খেয়ে পড়ে থাকে। আর ব্যথায় কাতর হয়ে যায়।
তারা আরও বলেন, মানুষ এতোটা কীভাবে নিষ্ঠুর হতে পারে। দেশে কি আইন নেই। এখনো কীভাবে তার স্বামী বাইরে থাকে। পুলিশ তাকে ধরছে না কেন। আর পরিবারেই বা কেমন খোঁজ-খবর নেয় না।
হাসপাতালের রোমানা নামে এক নার্স বলেন, সাথী খুব সাহসী মেয়ে। এত কষ্টের মধ্যেও কাঁদে না। কেবল কখনো বলে আমি কী আর বাঁচব? তখন আমাদেরও চোখে পানি আসে।
এ বিষয়ে সাথীর পালিত মা বিলকিস বানুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করব আমরা? তাকে আমি ২৪ বছর ধরে লালন পালন করে মানুষ করলাম। পড়াশোনা করালাম। বিয়ে দিলাম। কিন্তু সে দুইটা ছোট ছোট বাচ্চা রেখে পালিয়ে যায়। আবারো বুঝায় শোনায় টাকা খরচ করে আগের স্বামীর কাছে পাঠালাম। ১৫ দিন সংসার করার পর বাচ্চাদের রেখে পালিয়ে যায় তার জন্মদাতা মায়ের কাছে। তার সংসার আটকানোর জন্য আমি তার হাত-পা পর্যন্ত ধরেছি। কিন্তু সে আমাকে বলে- তুমি কে, তুমি কি আমাকে পেটে ধরেছো?। এরপর সে রুবেলকে বিয়ে করে। আমি মনে করি তার এই অবস্থার জন্য সে নিজেই দায়ী। আমা