ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি : বিদ্যালয়ে কর্মচারী নিয়োগে দিনের পরীক্ষা রাতে হতো। ঘুষের বিনিময়ে এমন ঘটনাই ঘটেছে ঠাকুরগাঁওয়ে। এর সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার ভেলাতৈড় আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল ওদুদ ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ আরিফুল্লাহর বিরুদ্ধে।
এছাড়াও ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে জাল সনদে প্রধান শিক্ষক হওয়া, বিদ্যালয়ের অর্থ আত্মসাৎ ও কর্মচারী নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগে জানা গেছে, আব্দুল ওদুদ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান ২০১৯ সালের শেষের দিকে। প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য ২০২৩ সালে কাগজপত্রের জটিলতায় প্রক্রিয়া বন্ধ থাকে। কিন্তু সে বছরেই সবার অজান্তে কখন, কিভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে প্রধান শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্ত করে নেন—তা এখনো ধোঁয়াশায় রয়ে গেছে।
২০২১ সালের নীতিমালা অনুযায়ী প্রধান শিক্ষক হতে গেলে স্নাতক পাসের ক্ষেত্রে দুটিতে দ্বিতীয় বিভাগ থাকতে হয়। কিন্তু আব্দুল ওদুদ স্নাতক পাস, এবং তাঁর শুধুমাত্র একটিতে দ্বিতীয় বিভাগ। তাহলে তিনি প্রধান শিক্ষক হলেন কীভাবে? আর এমপিওভুক্ত হলেনই বা কীভাবে?—এমন প্রশ্ন বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকসহ অনেকের মনে। তাঁদের দাবি, তাঁর নিয়োগ ও বেতন-ভাতা সবই অবৈধ।
অভিযোগে আরও জানা যায়, বিদ্যালয়ে ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট, আয়া ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে নিয়োগের জন্য প্রার্থীদের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেই টাকা দিয়ে তিনি পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করেছেন। চাকরি দেওয়ার নাম করে আরেক ব্যক্তির কাছ থেকেও তিনি টাকা নিয়েছেন এবং তাকে নানা ভাবে হয়রানি করেছেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নে তাঁর কোনো ভূমিকা নেই; বরং তিনি বিদ্যালয়কে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন।
বর্তমান উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ আরিফুল্লাহ, প্রধান শিক্ষকের আত্মীয়। তাঁর সহযোগিতায় এসব অপকর্ম করে আসছেন তিনি। অনুসন্ধানে জানা যায়, মোহাম্মদ আরিফুল্লাহ প্রায় পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে একই স্টেশনে চাকরি করছেন। এর আগেও তিনি একই স্থানে দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাব খাটিয়ে এসব করেছেন, আর বর্তমানে আরেকটি বড় দলের ছত্রছায়ায় থেকে দাপটের সঙ্গে এসব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, “একসঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করছি। তাঁর সার্টিফিকেট আমি জানি, আমার সার্টিফিকেট উনি জানেন। তাঁর চার পয়েন্ট হয়, কিন্তু পাঁচ পয়েন্ট কিভাবে হলো?”
সহকারী শিক্ষক মনসুরা খাতুন বলেন, “প্রধান শিক্ষক চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে এত টাকা নিয়ে কী করলেন? বিদ্যালয়ের ফান্ডেও জমা করেননি। আবার সহকারী থেকে প্রধান হলেন—এটাও জানতে পারলাম না।”
সহকারী শিক্ষক বিনোদ চন্দ্র রায় বলেন, “যেদিন কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষা, সেদিন বিকেলে হঠাৎ করে আমাকে ডাকলেন। সন্ধ্যার সময় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এলেন। প্রধান শিক্ষক বললেন, চলেন ঠাকুরগাঁওয়ে যেতে হবে। সভাপতির গাড়িতে করে ঠাকুরগাঁওয়ে গেলাম। রাত তখন প্রায় ১০টা। একটি কনসেপ্ট স্কুলে নিয়ে গেলেন। সেখানে প্রার্থীদের নামমাত্র পরীক্ষা নিলেন। পাশে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের পাঁচতলা বাসা, তিনি নিজেই বললেন—‘এইটা আমার বাসা।’”
সহকারী শিক্ষক সাদেকুল ইসলাম বলেন, “নিয়োগের ক্ষেত্রে টাকা নেওয়া হয়। ডিও, মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারসহ বিভিন্ন জায়গায় টাকা দিতে হয়। এটা শুধু এখানে নয়, গোটা বাংলাদেশের একই চিত্র। তবে এখানে হয়তো কারো স্বার্থে আঘাত লেগেছে, কেউ টাকার ভাগ পায়নি, তাই এসব করছে।”
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ মাহমুদ শাহরিয়ার বলেন, “আমার বাবা মারা যাওয়ার পর আমাকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমি এ বিষয়ে তেমন কিছু জানতাম না। প্রধান শিক্ষক একদিন রাতে জানালেন ঠাকুরগাঁওয়ে যেতে হবে। নিয়ে গেলেন ঠাকুরগাঁও শহরের ঘোষপাড়ায়। গিয়ে দেখি কেজি স্কুলে চারজন প্রার্থীর পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রধান শিক্ষক নিজেই সব কিছু করেছেন।”
ঠাকুরগাঁও পৌরশহরের ঘোষপাড়ায় অবস্থিত কনসেপ্ট স্কুলের (কেজি স্কুল) সভাপতি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ আরিফুল্লাহ। তিনি ১০-১৫ বছর ধরে সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে আছেন। স্কুল চলাকালীন সময়ে কোনো পরীক্ষা হয়নি, তবে রাতে নিয়োগ পরীক্ষা হয়েছিল কিনা—এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারেননি কনসেপ্ট স্কুলের অধ্যক্ষ শামিম আরা বেগম।
ভেলাতৈড় আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল ওদুদ অভিযোগের বিষয়ে জানান, “সহকারী শিক্ষকরা আমার কাছ থেকে সকলে টাকা নিয়েছেন। আমার কাছে সব কিছু লিখা আছে—কে কত টাকা নিয়েছেন। কিছু বিষয় মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক।”
পীরগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ আরিফুল্লাহ বলেন, “আগের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে বর্তমান প্রধান শিক্ষকের মানসিক দ্বন্দ্ব আছে। ছোটখাটো অভিযোগ—এতে দোষের কিছু নেই। আর দিনের পরীক্ষা রাতে হয়েছে—এরকম কিছু জানা নেই।”
তদন্তকারী কর্মকর্তা পীরগঞ্জ উপজেলা আইসিটি অফিসার সুমিত গুপ্ত জানান, “ইতিমধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। তদন্তকালে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে।”
পীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রকিবুল হাসান বলেন, “তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”